“দাদু আমার ঘড়ির সাইড পিন টা সারিয়ে দিওনা গো,বেরিয়ে আসছে থেকে থেকে “
কোনটা?নীল ব্যান্ড না স্পোর্টস ওয়াচ্ টা?
আরে স্পোর্টস টা…. ওটাই তো আমার ফেভারিট্, জানো তো তুমি”
ঠিক আছে, দে।কোর্ট থেকে ফেরার পথে করিয়ে আনবো।
ড্রেসিং টেবিলের উপর আছে।তোমার চশমার পাশেই। ওকে?
আচ্ছা বেশ।
ইমন রান্নাঘর থেকে শুনছিল দাদু-নাতির বার্তালাপ।ভাতের থালাটা বেড়ে আনলো বাবার জন্য। ছেলেকে বলল আর একটা টোস্ট দেবো?
দাও।তবে বাটারের উপর বেশি করে চিনি দিও।
মেঘ ব্রেকফাস্ট করতে করতে দাদুর সাথে আরো একটু বক্ বক্ করছিল।।ইমন ওকে একটু কপট ধমকে বলল,বেশি বকাস না দাদুকে,গলায় কাঁটা লেগে যাবে।
বাবার কোর্টে যাওয়ার সাথে সাথে যেন একরাশ ফ্রী টাইম,সকালের ঝড়ের সমাপ্তি।
সকল থেকে একগাদা ঝক্কি থাকে।একই সময়ে জলখাবার ও ভাতের জোগাড়,কাজের মাসির তালে তাল ঠোকা,মুহুরী অলোকের হাঁকাহাঁকি,এক-দু রাউন্ড চা,বাসি বিছানা তোলা….সব ইমনের মা ভৈরবী দেবী একা হাতেই সামলান।দীপক বাবু বেড়িয়ে যেতেই সময়টা যেন থমকে যায় বিকেল চারটে অবধি। তার মধ্যেও কাজ অনেক ই থাকে,কিন্তু কোনো তাড়া নেই। নিজের খাওয়া দাওয়াও যেন হলো তো হোলো গোছের …..।
এখন অবশ্য কটা দিন ভৈরবী দেবীর ভালোই কাটবে।ইমন এসেছে যে!সঙ্গে মেঘ….তাঁর নাতি সাহেব।
মাকেও জলখাবার টা এগিয়ে দিয়ে টেপ রেকর্ডার এ কৌশিকির ক্যাসেট টা চালিয়ে দিল,এবারেই আসার সময় এনেছে ওটা মায়ের জন্য। মা যে গান শুনতে খুব ভালোবাসে।
ইমন নিজে চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে নিজের ঘরে এলো।হ্যাঁ,এটাই ওর নিজের ঘর….বিয়ের আগে পর্যন্ত সমস্ত সুখ দুঃখের ইতিহাস লেখা আছে এর প্রতিটা ইঁটে।বিয়ের পরেও ও এলেই ওর আর ওর বরের জন্য এটা বরাদ্দ থাকে। বাকি সময় টা এটা মায়ের লেখা লেখির ঘর,তাই তাক জুড়ে সিলেবাসের বই গুলো পাল্টে গেছে এখন বিভিন্ন লেখকের কবিতা, গল্প, উপন্যাসের বই এ।খাটের পাশের সাইড টেবিলে কাগজ,ডাইরির গাদা। প্লাস্টিকের ছোট পায়া সবুজ রঙের রাইটিং টেবিলটি খাটের উপর। ওটার কোনো জায়গা নেই, রাতে মাটিতে নামিয়ে রাখা হয়,সকালে বাসি ঘর পরিস্কার করার সময় বেডকভার বিছানো হয়ে গেলে আবার খাটের উপরে উঠে আসে।
বড্ড প্রিয় ওটা মায়ের,কাজের ও খুব…. বেশ সুবিধা হয় মায়ের আজকাল ওটার উপর রেখে লিখতে।
অনেকে নজর দিয়েছে ওটা তে,অর্ডার ও।কিন্তু এ জিনিস এখানে পাওয়া যায়না।নীলকমল কম্পানির প্রডাক্ট, কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার কলকাতার ব্রাঞ্চে পাওয়া যায়না। ইমনের মামা পুনে থেকে এনে দিয়েছিল ওটা।
ইমন চায়ের কাপটা সবুজ টেবিল টাতে রেখে ভাবছিল মেঘ আর বাবার কথা গুলো……. ভাবছিল এই সেই বাবা যে কিনা ওদের দু ভাই বোন কে ঘড়ি পরার জন্য কত্ত বকেছে।আর আজ ক্লাস সিক্স এ পড়া নাতির ঘড়ি সারাতে সে ই গেল।মেঘ ওর পৈতে তে পাওয়া দুটো ঘড়ি নিজের কাছে রাখে।ঘুরিয়ে ফিরিয়ে পরে।গত মাসেই ওর পৈতে হলো,এখনো ভালো করে চুল গজায়নি মাথায়।
মনে পড়ে গেল বাবার পুরোনো হাত ঘড়ি টার কথা….জ্ঞান হবার পর থেকে দেখেছে বাবাকে সকালে একটা পার্টিকুলার টাইমে দম দিতে।খুব মজা লাগতো,দারুণ কৌতুহল ছিল ওটার প্রতি।দাদা তো প্রায় বলতো…..
একবার যদি ওটা পাইনা….মনের সুখে দম দেবো।ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখেবো কতোক্ষণব্যাপী দম ওটা নিতে পারে।
কিন্তু বাবার ভয়ে কোনোদিন ছুঁয়েও দেখতে পায়নি বেচারা।পাছে চাবিটা ভেঙ্গে যায়,আর চাবি যদি নাও ভাঙ্গে পিঠের হাড়টা তো অবশ্যই ভাঙ্গবে।
ইমন আপন মনে ভেবে চলে তার নিজের ছোটবেলার কথা।কতবার আব্দার করেছে একটা ঘড়ির জন্য….কিন্তু সবই অরন্যে রোদন।অনেক হা পিত্তেশ করার পর শেষমেশ বাবা কথা দিলো কিনে দেবে….কিন্তু মাধ্যমিক পরীক্ষার পর,তাও আবার ইমপোসড্ টার্ম আর কন্ডিশনের ভিত্তিতে।
এখন স্কুলে স্কুলে পরীক্ষার সময় ঘড়ি মাস্ট।কিন্তু তাদের সময় পরীক্ষার জন্য ঘড়ি ছিল না,ছিল ঘড়ির জন্য পরীক্ষা। বাবার শর্তাবলী অনুযায়ী নম্বর না পেলে তা যে আবার উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত পোস্টপন্ড হয়ে যাবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
দাদার কপাল ভালো ব্রাহ্মণ পুত্র হওয়ার সুবাদে ক্লাস এইটে ওর পৈতে হলো,১৩ বছর বয়সেই সাত সাতটা ঘড়ি পেল ও।যদিও তার ৬ টাই আলমারির লকারে থাকতো।একটা পেল হাতে।দেখে শুনে চয়েশ করে টাইমেক্স এর একটা ওয়াটার প্রুফ,অ্যলার্ম ওয়ালা ডিজিটাল ঘড়ি রেখে ছিল ও নিজের করে।
কিন্তু অতো বাহারি ঘড়ির ডায়েল খানা ছিল বেশ জব্বর, বেশ পেল্লাই।ওর লিকলিকে রিস্ট থেকে যেন বেরিয়ে আসতো।তা হোক! ওটাই ওর পছন্দ।
বেশ কিছু দিন ওটা পরার পর বন্ধুদের কাছে খুব টিটকিরি খেয়েছিল।ওর হাতে বেঢপ, বেমানান হওয়ায়। তারপর থেকে ওটা হাতে কম আর পকেটে থাকতো বেশি।
দাদার তো তবু কপাল খুললো,কিন্তু ইমনের ভাগ্যের সিকেয় সুতো কাটতে সেই মাধ্যমিকই ভরসা।
“সবর কা ফল মিঠা হোতা হ্যায়”।তাই আলটিমেটলি মাধ্যমিকের পর যখন পেল….. তখন পেল একটা টাইটানের সোনাটা ঘড়ি। উফ্ কি একসাইটমেন্ট!
ওসব কথা মেঘরা রা বুঝবেই না কোনোকালে।
প্রথম প্রথম মল্লার ঘড়ি টা পাবার পরও বাইরে পরে বেরোবার পারমিশন ছিল না।
তখন ও সন্ধে বেলা পড়তে বসার সময় আর রবিবার দুপুরে স্নান করতে যাওয়ার সময় নিয়ম করে পরতো হাতে।
এখনো বাবা জানেনা দাদা স্নান করার সময় ঘড়ি পরতো,জানলে রক্ষা থাকবে না!
বড় কেতা করে বলত মল্লার, ” ওয়াটার প্রুফ তো,ঠিক মত কাজ করছে কিনা দেখতে হবেনা? “
হঠাৎ ই ইমন একা একাই খিলখিলিয়ে হেসে উঠল।ইমনের স্মৃতির পর্দায় ভেসে উঠলো একটা একশন রিপ্লে।
মেঘ কখন এ ঘরে এসেছে ইমন খেয়াল ই করেনি।মেঘ মায়ের কান্ড কারখানা দেখে ধরলো মাকে, ও মা হাসছো কেন একা একা?
কিছু না।
বলোনা বলোনা,কেন হাসলে বলোনা।
ইমন মেঘকে আদর করে আরো একটু হেসে নিলো,বলল,সে তোর মামার একটা মজার ঘটনা মনে পড়ে গেল ছোটবেলার।
মেঘের উৎসাহ আরো বেড়ে গেলো,
কি ঘটনা গো?
খুব মজার।তোর মামা আর একটা কাকের কীর্তি।
ভৈরবী দেবীও উঠে এসেছেন ততক্ষণে এঘরে।
ইমন বলল ও মা! মেঘ কে দাদার ঘড়ির গল্পটা বলোনা।ভৈরবী দেবীও হাসতে শুরু করলেন।ঘরে ঢোকার সময়ই কাকের কথাটা কানে এসেছিল।
মেঘ এবার একটু মাথা চুলকে বলল ” ব্যাপারটা কি?মা বলল কাকের কীর্তি।আবার বলছে ঘড়ির গল্প।কি করেছিল কি মামা?”
ওরে তোর মামার অনেক মজার মজার কান্ড আছে। হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে যাবে।
ওফ্ দিবু,বলো দিকি এবার।খালি হাসতেই ব্যস্ত।একটু রেগে গিয়ে বলল মেঘ।
তবে শোন,….মল্লার তখন তোর মতই হবে।সবে পৈতে হয়েছে মাস দুএক আগে।
ইমন ফুট কাটলো,মা দাদা তখন ক্লাস এইট,মেঘের থেকে একটু বড়।
আরে ঐ হলো।পৈতের দুমাস পরেই তো।
হ্যাঁ।
তিনি বলতে শুরু করলেন….তখন জুন মাস…. প্রচন্ড গরম…..সে বছরই ২৬ সে বৈশাখ মল্লারের পৈতে হয়েছিল।…..
ভৈরবী দেবী একগাল হাসি আর মনভরা আনন্দ নিয়ে নাতি সাহেব কে হাত ধরে নিয়ে গেলেন স্মৃতির পাতায়……
***************
কদিন থেকেই মল্লার একটু চুপচাপ। কেমন যেন লাগছে ওকে।
খাওয়ার সময় তাড়াতাড়ি খেয়ে নিচ্ছে…..হা করে টিভির মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে না।
বিকেল বেলা ডাকার আগেই বাড়ি ফিরে আসছে খেলে।
বলার আগেই পড়তে বসে যাচ্ছে।
ইমনের সাথে পায়ে পা লাগিয়ে যেচে ঝগড়া করছেনা,মারপিট তো নয়ই।
এতে বাধ্য ছেলে তো ও নয়।একটু যেন মন মরাও হয়ে আছে কদিন থেকে।প্রথম খটকা টা লাগে ইমনেরই।দাদার খুনসুটি গুলো মিশ্ করাতে।
মল্লার নিচের পড়ার ঘরে আগেই চলে এসেছিল,তাই মায়ের কাছে ইমন ধমক খেয়েছে… “তোর দেখছি দিন দিন অবনতি হচ্ছে,দাদা পর্যন্ত চলে গেল পড়তে আার উনি এখোনো সময় নষ্ট করছেন। “
ইমন ফুঁসতে ফুঁসতেই নিচে নেমে ছিল, মল্লার কে পড়া বাদ দিয়ে খুচরো পয়সা গুনতে দেখে আরো খচে গেল।
ও টাকা গোনা হচ্ছে? মা ভাবছে কতই না পড়ছে তার ছেলে!দাঁড়া বলছি মা কে….”.ম্…মা…আ….”
চুপ কর। চুপ, চুপ।দোহাই তোর।
চাঁদার টাকা গুনছিস না? তা কিসের এবার ফুটবল না ক্রিকেট টুর্নামেন্ট?
নাহ: কোনো টুর্নামেন্ট নয়।একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলল মল্লার।
তবে?এতোগুলো টাকা পেলি কোথায়?
কোথায় আর বেশি টাকা? মোটে ১৭০।কি হবে ওতে?হতাশা নিয়ে বলল ও।
এ..ক…শো…সত্তোর??চোখ কপালে তুলে বললো ইমন।তোর ব্যপার টা কি বলতো সত্যি করে।কেমন যেন ঠেকছে আমার!
কিছু না।
বলবি কিনা বল,না হলে বাবাকে বলছি তোর কাছে এতো টাকা আছে।
বুনিরে আরো অনেক টাকা দরকার আমার,মল্লার কে খুব অসহায় দেখালো।
ইমন কাছে গিয়ে আস্তে করে আবার জিজ্ঞেস করলো,কি হয়েছে রে?আমাকে তো বলবি।
মল্লারের চোখ দুটো ছলছল করে উঠলো।
দাদা?
আমার ঘড়ি টা হারিয়ে গেছে। চোখ আর বাঁধ মানলোনা।দুগাল বেয়ে জল নেমে এলো।বাবা জানলে আমার পিঠের চামড়া গুটিয়ে দেবে।
ঘড়ি টা??? ইমন আঁতকে উঠল।
উপর থেকে মায়ের গলার আওয়াজ এলো….কি করছিস কি,পড়া ছেড়ে তখন থেকে দুটোতে বক বক করছিস…আমি যাবো নাকি?
একটু সামলে নিয়ে গলা নামিয়ে বলল,
কিন্তু বাবা তো জানবেই,আজ নয় তো কাল।হারালো কি করে? টিউশনে নিয়ে গেছিলি নিশ্চয়।পকেটে থাকলে হারাতে কতক্ষণ? স্যার কে জিজ্ঞেস করেছিস?এ বাবা! আবার রাস্তায় পরে নি তো!
ধুৎ! তুই থামবি।খালি বকে যাচ্ছিস।
এঁ এ হ!সামলাতে পারে না আবার ঘড়ি পরবে!বাবা জানলে আর রক্ষা থাকবেনা….ইমনের গলায় আতঙ্ক স্পষ্ট।
এবার আর মল্লার নিজেকে ধরে রাখতে পারলোনা।ডুকরে কেঁদে উঠলো।
তোর কাছে কত টাকা আছে রে? দিবি আমায়?
৫০/৬০ হবে।কিন্তু কেন?
ঐ শেম মডেলের আরেকটা ঘড়ি কিনে নেব,বাবা জানতে পারার আগে।আমি দোকানে দেখে এসেছি, কিন্তু অনেক দাম….বলেই আবার ফুঁপিয়ে উঠলো।
কত দাম?
৭৮৫ টাকা।কিন্তু ৭১৫ টাকা লাগবে বলেছে।আমার কাছে ১৭০ আছে, কৌটো তে আরো ২২ টাকা।তোর কাছে ৬০।সোনা বলেছে ধার দেবে ৫০ টাকা।তাও ৪১৩ টাকা কম।কি করবো কিছু বুঝতে পারছি না।মাকে চাইলেই তো জানতে চাইবে কিসের দরকার।
কিন্তু আমার মনে হয় মা’কে ই বল।মা ই বাবার মার থেকে বাঁচাতে পারবে তোকে।এতো টাকা কে দেবে তাছাড়া?
কিন্তু হারালো কি করে?রাস্তায় পরে গেছে নাকি?
উত্তরে মল্লার যেটা বললো সেটা শোনার পর ইমন আর থাকতে পারলো না, হাসতে হাসতে গড়িয়ে পরলো।কিছু তেই থামাতে পারছেনা, হেসেই চলেছে।
আরো একবার মায়ের গলার আওয়াজ এলো…..তবু হি হি,হো হো হো করেই চলেছে। মল্লার করুণ গলায় বললো তুই হাসছিস!
ইমন শুধু বলতে পারলো…. এমনও হয়,হাসি যে তার বাগ মানছেনা।
ততোক্ষণে মা নেবে এসেছে, চুপিচুপি দাঁড়িয়ে বোঝার চেষ্টা করছে ব্যাপারটা।কিন্তু কিছুই বুঝতে পারছেনা,একজনের চোখে জল,আরেকজন হেসে খুন।এতো ঝগড়া মারপিট নয়….কি চলছে ওদের মধ্যে! ঘরের মধ্যে ঢুকে এলো মা, মল্লার খুব ঘাবড়ে গেছে, ইমন হাসতে হাসতে শুয়ে পড়েছিল,উঠে বসলো।তাড়াতাড়ি বই খুলতে গেল,কিন্তু হাসি টা এখনো সামলে উঠতে পারেনি।
*************
এ বাবা! অনেক বেলা হয়ে গেল যে।যা যা স্নান করে নে,খেতে অনেক দেরি হয়ে যাবে।ভৈরবীদেবী বলে উঠলেন।
ওহ! দিবু,ঘড়ি টা কি করে হারালো বলবে তো।মা হাসছিল কেন।
তুই আগে স্নান সেরে আয় তারপর বলবো।
ইমন বলল,হ্যা যাও।আমি টেবিল রেডি করি ততক্ষণ।
না তুমি আগে বলো।নাহলে আমি যাবো না।
বেশ যাসনা,বসে থাক।তোর স্নান খাওয়া না হলে আমিও বলবোনা।
মেঘের মুখে উদ্বেগ দেখে মা মেয়েতে চোখ টিপলো।
খুব মজা লাগছে দুজনেরই,সেই দিন গুলো যেন দেখতে পাচ্ছে দুজনেই।অগত্যা মেঘ কে হার মানতে হল।ঝট করে স্নান করে নিয়েছে সে,খেতে খেতেও বার কতক জিজ্ঞেস করলো…. দিবু বা মা কিছুই বলল না।অন্য কীসব বলে যাচ্ছে।
মা বাবাকে বোলো তো একবার লকার থেকে দাদুর বাবার ঘড়ি টা বের করে আনতে,মেঘকে দেখাবো।এমন জিনিস তো কেও চোখে দেখেনি।সকাল থেকে আজ যা ঘড়ি পর্ব শুরু হয়েছে,তাই ওটার কথা মনে হলো।
আমাকে দেখাতে হবেনা।আমি কি করবো মান্ধাতার আমলের ঘড়ি দেখে।
ও দাদুভাই যেমন তেমন ঘড়ি নয় রে।সোনার ঘড়ি। তার চেনটাই দুভরির।খুব সুন্দর তাও হাত ঘড়ি নয়,পকেট ঘড়ি। তখন তো সবাই পকেট ঘড়িই ব্যবহার করতো।
পকেট ঘড়ি মানে?মামার মতো পকেটে রাখতো?
না না।পাঞ্জাবির বুক পকেটে থাকতো। আর চেন টা বোতাম হোলে আটকে রাখা হতো।তাই শেষ প্রান্তে একটা বোতাম থাকতো।তোর দাদুর দাদুর ঘড়িটাতে বোতামের জায়গায় একটা হার্ট আছে।মাঝখানে গোলাপী পাথর বসানো। আর তোর মামা তো প্যান্টের পকেটে নিয়ে ঘুরতো।তোর দাদুকে বলবো,এনে দেখাতে।
কত স্মৃতি! কত ঐতিহ্য! আগে দেখিস তার পর বলিস।
বেশ,সে দেখবো।আগে মামার ঘড়ি টা কি করে হারালো বলো।
যা হাত ধুয়ে আয়, বলছি।
বলো না…..
একগাল হেসে বলল, কাকে নিয়ে গেছে।
দিবু বাজে কথা বোলোনা……বলোনা কি হয়েছিল।
হাত মুখ ধুয়ে দিবুর খাটে এসে বলল, বলো দিকি এবার সত্যি করে,কি করে হারালো।
বললাম তো।কাকে নিয়ে গেছে ঘড়িটা।
(কিভাবে নিলো কাকে ঘড়িটা, তার পরই বা কি হলো জানাবো কালকে………….যদি আপনাদের ভালো লাগে।)
বাবার স্নেহ
কমলিকা মুখার্জ্জী
(দ্বিতীয় পর্ব)
এ্যঁ? কাকে? মল্লার এ চোখে প্রবল সন্দেহ ও বিস্ময়!।
এ্যঁ নয় হ্যাঁ,কাকেই নিয়ে গেছে ঘড়িটা ওর চোখের সামনেই।
************
ছুটির দিন। দুপুর বেলা পাশের গলিতে ক্রিকেট খেলে সবে এসেছে মল্লার।
খট খটে রোদ।জামাটা ঘামে ভেজা।ওটা খুলে কাঠের চেয়ারে ছুড়ে দিল।স্নান করতে যাবে।উঠোনে গামছা নিতে গেল।
আজ আবার বল হারিয়ে গিয়েছিলো।চাঁদা করে বল কেনা হয়েছে। পকেটে বাকি খুচরো গুলো আছে।আর ওর প্রিয় টাইমেক্স ওয়াচ টা।সব সুদ্ধ মুঠো করে বার করে উঠোনের চৌবাচ্চা টার কিনারায় রাখলো।তারপর খুচরো গুলো বাঁ হাতে তুলে নিয়ে ডান হাত দিয়ে গুনছিল।
তিনটে আধুলি,একটা একটাকার কয়েন,দুটো সিকি……
হঠাৎ একটা কাক এসে প্রায় মাথার কাছে ঝাপটা মারলো।মল্লার অতর্কিত হামলায় ঘাবড়ে গিয়ে দুহাতে নিজেকে বাচাতে আড়াল করলো।
তার পর চোখ খুলতেই সামনে কালো কিস্কিন্দা কাক টাকে দেখতে পেল। আর তার মুখে মল্লার এর সাধের টাইমেক্স ওয়াচ্।ধরাস করে উঠলো মল্লারের হৃদ যন্ত্র।
কাকটা উড়ে গিয়ে পেয়ারা গাছের ডালে বসলো।হুস্ হুস্ বলতেই ব্যাটা ঘড়ি সমেত উড়ে গেল রাস্তার দিকে।
মল্লার একছুটে নিচের দরজা খুলে রাস্তায় বেরোলো। খালি গা,পায়েও জুতো নেই।
নিচে আসার সময় একটানে জামাটা নিয়ে নিয়েছিল হাতে, ওটা কোনো রকমে দুহাতে গলিয়ে বেরোলো সদর দরজা খুলে।
কাক বাবাজী ইলেকট্রিক তারে বসে বসে দুলছে । তাকাচ্ছে সে এদিক ওদিক, মুখে ধরা ঘড়ি টা।
হুস বলতেই আবার উড়ে গেল।
যা না বাবা যা! কে আটকেছে? তা বলে ঘড়ি নিয়ে ওড়ার কি আছে।ফেল ওটা।ফেল।ফেল।
নচ্ছার কাক মাথার উপর দিয়ে উড়ছে….নিচে নিচে দৌড়াচ্ছে মল্লার খালি পায়ে।জামাটা হেঙ্গারে ঝুলছে,বোতাম লাগানো নেই একটাও।হাড়গিলে বুক,পাঁজর আার পৈতে টা দেখা যাচ্ছে।
দুপুরের রাস্তায় লোক কম,যে ক জন আছে তারা কিছু বোঝার আগেই মল্লার তাদের টপকে যাচ্ছে। পায়ের তলাটা গরমে জ্বলে যাচ্ছে। মল্লারের সে সব ভাবার অবকাশ নেই।
মল্লারকে অনেকটা দৌড় করিয়ে এনে কাকটা একটা মোটা অশ্বত্থ গাছের ডালে বসলো মাঠের মুখ টায়।
হাঁপাচ্ছে মল্লার।মুখটা গরমে লাল হয়ে গেছে। কাকটা গাছে বসায় আশা পেল।আবার হুস হুস…। ব্যাটা বসেই আছে।
ওরে শয়তান, আমার ঘড়ি টা দে।ওটা কি তোর খাবার নাকি?তোর কি কাজ ওতে! দে বাপ্।ফেরৎ দে।
মল্লার তার হাড়গিলে চেহারা নিয়ে গাছ টা ঝাঁকাবার চেষ্টা করলো,কিন্তু গাছের গুড়ি ধরে সে শুধু নিজের শরীর টাই নড়ালো।কাকটা যেন একবার ওর দিকে তাকাল জুলজুলে চোখে তারপর বড়ো অবজ্ঞার সাথে মুখটা ঘুরিয়ে নিলো।
ব্যাটা বসেই আছে।একটা ঢিল ছুঁড়লো মল্লার…… কাছেও গেলনা সেটা কাকটার।আরো একটা।
এবার কাক আবার ডানা মেলল।আর মল্লার নিচে নিচে দৌড়।এতো কাঁ কাঁ করে।আজ একটি বার কর বাবা! সেই চৌবাচ্চা থেকে একটি বারও ডাকেনি।
এবার কাক উড়তে উড়তে মাঠ পেড়িয়ে জেল খানার ভেতর ঢুকে গেল।মল্লার হাঁ করে দাড়িয়ে রইল।চোখ দুটো জ্বলছে,গরম জল গড়িয়ে আসছে গাল বেয়ে।ঘাম,ধুলোর মধ্যে চিরাচরিত ছবি এঁকে ফেলল তা মল্লারের ফর্সা গাল দুটেতে।।অনেক ক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল মল্লার…..যদি কাকটা ফিরে আসে।
“শালা মরবি আজকেই।কিচ্ছু খেতে পাবিনা দিনভর। মুখটা তোর সেঁটে যাবে,দেখিস খুলবেই না আর! খাবার সামনে থাকলেও হা করে খেতে পারবিনা। একদম ঠিক জায়গা তেই এসেছিস,ছিনতাই বাজ কথাকার।তোকে যদি জেলের গারদে পুরতে পারতাম তবে শান্তি হতো।অসভ্য কথাকার।” গড়গড় করতে থাকে মল্লার।
একটা নয় দু দুটো কাক এলো জেলখানার ভেতর থেকে উড়তে উড়তে,কে জানে ঔ টাই,নাকি অন্য কোনো!
কাকদুটোর একটার মুখেও ছিল না তার সাধের ঘড়ি টা। সাত আটশো টাকার ঘড়ি,সে কিনা একটা চোর ছ্যাচোর জেলে বসেই পেয়ে গেল এমনি,এমনি! কান দুটো মল্লারের রাগে লাল হয়ে উঠলো।
যত স্পীডে ঐ রাস্তা দিয়ে গিয়েছিল, ততটাই ধীরে ফিরে এলো ও বাড়ি তে।
যত বাড়ির কাছাকাছি আসতে লাগলো,তত তার গলাটা শুকিয়ে এলো…..কী বলব এবার বাড়িতে?
দুদিন ধরে অনেক ভেবেছে মল্লার।মাকে বলবো কি বলবোনা,কি বলা যায়……..
বুধবার সকালে তপন স্যারের ক্লাস ছিল, সোনাতোড় পাড়ায়,ফেরার সময় মানিক মারোয়াড়ীর সাইকেল দোকানের পাশে এসে হঠাৎ থমকে যায়।
পাশের ঘড়ির দোকানটা ঘরঘর আওয়াজ করে সার্টার টা সবে তুলেছে…….।দোকানটা ঝাট্ দিয়ে পরিস্কার করছে…..মল্লার কিংকর্তব্যবিমূঢ়ের মতো দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ।তারপর সটান ঢুকে পড়লো ভেতরে। ঘড়ি গুলোর দিকে চোখ চালিয়ে নিজের ঘড়ির মডেল টা দেখতে চাইলো।দেখলো,দাম করলো,পরে এসে নিয়ে যাবো বলে চলে এলো।
বেশ হাল্কা লাগছে মল্লারের নিজেকে।
কদিন ধরে খুব টেনশন এ ছিলো, কি বলবে বাবা-মা কে।কোথায় গেল ঘড়ি টা।খুব ফুরফুরে লাগলো নিজেকে নিজের আইডিয়ায়।
একটা নতুন ঘড়ি কিনে আনবো,কারুর কিছু জানার আগেই, শেম মডেল,শেম কালার।
কিন্তু এবার অন্য চিন্তার মেঘ ঘনীভূত হল মল্লারের মাথায়।
সা আ ত শো পনেরো টাকা….কোথায় পাবে? কে দেবে?
তারপর থেকে প্রতি নিয়ত সেই চিন্তায় ভার হয়ে আছে মাথা।
এ কদিন ফ্রিজের মাথায় খুচরো পরে থাকলে সরিয়েছে,টিফিন বাবদ চার টাকা করে রোজ বাঁচিয়েছে না খেয়ে।
বল হারিয়েছে বলে মায়ের কাছে দশ টাকা চেয়ে নিয়ে গেছে।
বাবার কাছে খাতা কিনতে পনেরো টাকা নিয়েছে। এবার?…..আর তো কোন উপায় ও দেখছেনা….পাশের বাড়ির সোনার কাছে ধার চেয়েছে।বলেছে ছ’মাস পর ফেরৎ দেবো।
সোনা অবশ্য ফিরিয়ে দেয়নি।রাজি হয়েছে ধার দিতে।তবে সোনার একটা কাজ করতে হবে তার বদলে।একটা চিঠি পৌঁছাতে হবে একজনকে….মল্লার সব করে দেবে বলেছে।ওর টাকাটা চাই ব্যাস।
***********
মা চেপে ধরাতেই ইমন সব বলে দিল মাকে।
কাতর গলায় বলল ” কিছু একটা ব্যবস্থা করো মা।বাবা নাহলে খুব মারবে ওকে”………”তুমি দেবে মা চারশো টাকা দাদকে।”
কিন্তু ঘড়ি টা কি করে হারালো বলতে গিয়ে আবার হাসছে খ্যাক খ্যাক করে।
মায়ের কাছে ধরা পরে গিয়ে মল্লার চুপ করে দাড়িয়ে আছে, চোখ দিয়ে গড়গড় করে জল গড়াচ্ছে। তার উপর ইমন কে হাসতে দেখে খুব খচে যাচ্ছে।
ইচ্ছে করছে দি’ একটা আচ্ছা সে।মা গেলেই চুলগুলো ছিঁড়ে নেবো।কিন্তু কিছু করার নেই। মা আছে সামনে।তাতে সে দোষী।
সব শুনে মায়েরও বিষম খাওয়ার জোগাড়।
বলছিস কি রে? তোর সামনে দিয়ে নিয়ে গেল,তুই হাঁ করে দেখলি,কিছু করতে পারলিনা?
আমি কী করবো মা?কাকটা এক ঝটকায় নিয়ে পালালো।আমি অনেক চেষ্টা করলাম ওটা ফিরে পেতে।কিন্তু…..
এবার ভৈরবী দেবীও হাসতে শুরু করলেন। ঘড়ি হারাবার কথা শুনেও মা হাসছে দেখে মল্লার মনে বল পেল।
ওরও এবার একটু হাসি ফুটল মুখে।চোখে জল মুখে হাসি নিয়ে বলল,
” মা বাবাকে বলবেনা তো,বলো বলবেনা তো।বাবা তালে খুব মারবে।”
আমাকে আর কোনোদিন জীবনে ঘড়ি পরতে দেবেনা।কিনে তো দেবেই না….আমার বিয়েতে আমার শ্বশুড়ও ঘড়ি দিলেও সেটা পরতে দেবেনা।
শেষের কথা গুলো শুনে ভৈরবী দেবী ও ইমন আবার হো হো করে হেসে উঠলো। মল্লারও হাসছে,আবার চোখ দিয়ে টপ টপ করে জল পরছে।
(মল্লার কে কি মা টাকা দিয়েছিল?নাকি বেদম প্রহার খেল ধরা পরে গিয়ে?………..
শেষ পর্বে কাল দুপুরেই ফিরে আসছি।)
বাবার স্নেহ
কমলিকা মুখার্জ্জী
(অন্তিম পর্ব)…..আগের পর্বের লিন্ক কমেন্ট বক্সে 💙
হো হো হো হো,ও মাই গড্,হো হো,হা হা,হা……..
মেঘ শুয়েই পরেছে হাসতে হাসতে….. ইমন আার ভৈরবী দেবী ও হাসছে…….মেঘেকে এভাবে হেসে লুটোতে দেখে ওরা আরো বেশি মজা পেয়েছে।
ওহ্,আজ যা শোনালে না দিবু…..থ্যান্ক ইউ মা……তুমি ওরকম পাগলের মত একা একা না হাসলে জানতেই পারতামনা এত্ত ইন্টারেস্টিং স্টোরি টা।
আমি পাগল?এক থাপ্পড় দেবো।খুব বেড়েছো না?ইমন মেঘকে জড়িয়ে ধরলো।
হ্যাঁ,দিবু?….শেষে তুমি টাকাটা দিলে?…..দাদু জানতে পারেনি তো….নাকি মামা ক্যালানি খেল দাদুর কাছে?
না দিইনি।দিতে হয় নি।
মানে?….মেঘের চোখ আবার বড় বড় হয়ে গেছে। তারমানে দাদুর কাছে ধরা পড়ে গেল,নাকি!
ওফ্,বড্ড অধ্যৈর্য আজকালকার বাচ্চা গুলো।গল্পো এখনো শেষ হয়নি।শুনবি তো চুপটি করে বস।না তো আমি আর বলবোনা।
মেঘ খুশিতে ডগমগ করে উঠল।
জিও! গল্পো আরো আছে…….পিকচার আভি ভি বাকি হে….জিও দিবু,জিও।
মেঘের কায়দা দেখে ভৈরবী দেবী খুব মজা পেলেন।মেঘের মাথায় একটা চাঁটি মারলেন মিষ্টি করে।
আচ্ছা বলতো তোকে মা বেশি বকে না বাবা?
অফকোর্স মা।সারাদিন তো বকতেই থাকে।
ইমন চোখ পাকালো।কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু ভৈরবী দেবী বলে উঠলেন, আর কে বেশি ভালোবাসে?
দুজনেই….বুদ্ধি করে উত্তর দিল মেঘ।
আর তুই কাকে বেশি ভালোবাসিস?
মা কে।প্রম্টলি বলল মেঘ।
খুব সেয়ানা না!ইমন ওর গালটা টিপে দিল।
না মানে বাবাকেও বাসি,তবে বাবাকে ভয় লাগে বেশি।বাবা এমনিতে বকেনা, কিন্তু বকলে হাড় হিম মেরে যায়।তাছাড়া মারলে তো আর রক্ষা নেই।
আচ্ছা বাবু মনে করে বলতো এমন একটাও ঘটনা যেখানে তুই দোষ করিসনি,অথছ বাবা বা মা তোকে খুব মেরেছে বা বকেছে,ভৈরবী দেবী বললেন।
মেঘ একটু ভাবলো সিলিং এর দিকে তাকিয়ে…. তার পর বলল,নাহ্,মনে পড়ছে না।প্রত্যেকবার মার খাবার পর ইকুয়েশন টা বিগরে দেয় বাবা।আমার ভুল গুলো দেখিয়ে দিয়ে।
একদম।একদম ঠিক এটাই বলতে চাইছি।মা বাবারা সব সময় নিজের সন্তান দের ভালোবাসে….কিন্তু বকে,মারে তাদের ভালোর জন্যই।
“শাসন করা তারই সাজে সোহাগ করে……..
ঔ ঔ…আবার তোমার বাংলা ইডিওমস্ শুরু করলে…..দিবুকে শেষ করতে না দিয়ে মেঘ বলে উঠল……
গল্প টা বলোতো, ওসব ছেড়ে।
হ্যাঁ রে পাগলা সেটাই বলছি।তোর দাদু বড়াবড়ই রাগি মানুষ, কম কথা বলে।
জানিস আগে একটা সিরিয়াল হতো “ঘুটন” নামের, ওতে রাজা মুরদ্ বলে একজন একটর ছিলেন, খুব গম্ভীর আর রাগী….. সবাই তোর দাদুকে তাঁর সাথে তুলনা করতো,মুচকি মুচকি হাসছেন তিনি।
কিন্তু দাদুও তোর মাকে, মামাকে খুব ভালো বাসতো,বাসে।ছেলেমেয়ের গায়ে আঁচ টি লাগতে দেবেনা।
কি জানিস তো, রেগে গেলে তোর দাদুর মাথার ঠিক থাকেনা।….বেমক্কা মেরে দেয় যেখানে সেখানে…. ওতেই আরো বেশি ভয় লাগতো ওঁকে।রাগারাগি কত্ত হয়েছে এই নিয়ে!
একবার পরীক্ষার দিন সকালে মল্লার বই হাতে বসে বসে ঢুলছে….. সেটা দেখে ও এমন চড় কষালো ,কান গোড়ায় চার আঙ্গুলের দাগ বসিয়ে দিলো।আধঘুমে সজোরে চড় খেয়ে তোর মামার যা হাল হয়েছিল না।ভাব একবার, আচকা এমন চড়ে যদি বেকায়দায় লেগে যেতো!
মেঘের ধৈর্য্য চ্যুতি হচ্ছে দেখে আবার সেদিনের ঘটনায় ফিরলেন।
সেদিন সব জানার পর আমি আরো একদিন সময় নিলাম,অনেক ভাবলাম।তারপর দিন রাতে তোর দাদুকে দিয়ে আমার মাথায় হাত রাখিয়ে দিব্যি কাটালাম…..যে আমার পুরো কথা না শুনে রাগবেনা।আমি ভেবেছিলাম তোর দাদুকে আমি বুঝিয়ে নেবো যে ওতে মল্লারের কোনো দোষ ছিল না।ওটা একটা নিছক এক্সিডেন্ট।
সব বললাম দাদুকে।বলছি আর ঠাকুর ডাকছি, “ছেলেটার দোষ নেই….হে ঠাকুর তুমি দেখো।”
শেষ পর্যন্ত সব বলার পর কি হলো জানিস?
কি?
তোর দাদুও হো হো করে খুব জোরে হেসে উঠলো….. আমি তো অবাক।এতো হাসছে! একটুও রাগলোনা মানুষ টা!
বলল,এতে রাগার কি আছে? তোমাদের কোনো চিন্তা করতে হবে না….ওর ঔ ঘড়ি ও পেয়ে যাবে।
মানে?
….হ্যা,আমিও এভাবেই অবাক হয়ে বলেছিলাম…মানে?
তোর দাদু হেসে বলল,ইনসীয়োরেন্স করা আছে….ও ঘড়ি পাওয়া না গেলেও ওর মূল্য পাওয়া যাবে।বলে ঘুমিয়ে গেল।
ঘড়িরও ইনসীয়োরেন্স হয় নাকি আবার।এতো বাপের জন্মে শুনিনি।
ইমন ধমকালো,বড্ড বাজে কথা শিখেছিস! তোর জন্মটা তো সবে ১১ বছর….শেখার এখন অনেক বাকি।সবে তো শুরু…..বাপের জন্মের শিক্ষা এখোনো অনেক দুরে।আগে নিজের জন্মের টা শেখ্।
আমিও সেদিনই প্রথম জানলাম।
হাউজ্ হোল্ড ইনসীয়োরেন্স এর কথা।হাউজ্ হোল্ড ইনসীয়োরেন্স এ বাড়ির সব কিছুই ইনসীয়োর করা যায়।টিভি, ফ্রিজ,এসি এসব ইলেকট্রনিক জিনিস ছাড়াও শাড়ি, সুট,সোনার গয়না,পাখা,ঘড়ি সব কিছুই……
লিস্ট করে কোম্পানি তে জমা দিতে হয় সব কিছু। এমন কি কাজের মাসির ও ইনসোরেন্স হয়।
এ্যাঁ,সেটা আবার কি?
এই ধর রান্না করতে গিয়ে আগুন লাগলো,রেখা মাসি মরে গেলো…..তখন ওর পরিবার ঐ দুর্ঘটনার জন্য একটা টাকা পাবে।
তাহলে দাদু এবাড়ির জিনিস পত্র সব ইনসীয়োরেন্স করিয়ে রেখেছে?
হ্যাঁ,সে তো করিয়েছেই। তবে সব না,বেশির ভাগ জিনিস।এবাড়িতে কখনো চুরি হলে,বা কোনো ক্ষয়- ক্ষতি হলে আমরা সব পেয়ে যাবো বুঝলি? কোম্পানির পয়সায়।
এবাড়ির প্রায় সব কিছুই লিস্ট করা আছে কোম্পানির কাছে।
ও মা! তাই নাকি!
হ্যাঁ।শুধু তাই নয় সুটকেস আর পকেট ইনসীয়োরেন্স ও হয়।
যদি রাস্তায়, ট্রেনে,বাসে ব্যাগ ছিনতাই হয়,বা পকেট মার হয়…….তার জন্য এই ব্যবস্থা সরকারি ইনসোরেন্স কোম্পানি করে রেখেছে।
তবে উপযুক্ত প্রমাণ দিতে হয় ঘটনার সত্যতার।পকেট ইনসীয়োরেন্স এ সর্বোচ্চ এক লাখ টাকা পর্যন্ত পাওয়া যায়।তবে ওটা করানোটা একটু মুশকিল, সবাইকে দিতে চায়না।কিছু অসাধু লোকও তো আছে,যারা অকারণে টাকা ক্লেম করে ছিনতাই হয়েছে বলে।
সেদিন তোর দাদু থানায় একটা ডাইরি করে এলো,যে মল্লারের ঘড়ি টা বাস স্ট্যান্ডের কাছে ছিনতাই হয়েছে। ঘড়ির সিরিয়াল নম্বর লিখিয়ে এলো।
ইমন বললো,তা বটে।ছিনতাই ই তো।চোখের সামনে থেকে নিমেষে ছিনতাই।
টাকা পেয়ে গিয়েছিল ওটার জন্য?
হ্যাঁ রে।তবে পুরোটা পায়নি।পাঁচশো পেয়েছিল।আর ঘড়ি টা ছিল সাতশো পঁচাশি টাকার।
অবশ্য তার আগেই তোর দাদু মল্লারের জন্য ঐ মডেলের, ঐ রং এর ই আরেক টা ঘড়ি কিনে এনেছিলো।
আমি বারণ করেছিলাম,বলেছিলাম,আরো তো ছ’টা ঘড়ি আছে,তার থেকেই না হয় একটা ওকে দিয়ে দিই,আবার কেনার কি দরকার?
বলেছিলো,”না ওটাই চাই।ওটা না মল্লারের সব থেকে পছন্দের। তাছাড়া জীবনের প্রথম ঘড়ি, ওটা ওর অনেক দিন মন ভরে ব্যবহার করা উচিৎ। ওটার সেন্টিমেন্ট ই আলাদা “
কিন্তু আমায় বার বার করে বারণ করে দিয়েছিল মল্লারকে এ ব্যাপারে কিছু বলতে।আমি বলিওনি।ও বেচারা তখনও ওটা নিয়ে খুব টেনশন এ ছিলো।
তোর দাদু যেদিন নতুন ঘড়ি টা কিনে মল্লার কে দিলো,বলেছিলো,
“এবার থেকে সাবধানে রেখো।পকেটে নয় হাতেই থাকে যেন ওটা।তাই ফল,সাক্-সব্জি ভালোকরে খেয়ে একটু গায়ে গতরে লাগাও।নিজেকে ওটা হাতে পরার মতো তৈরি করো।”
সেদিন দীপক বাবু একটি বারও মল্লারকে বকেনি পর্যন্ত। কিন্তু ঘড়ি টা হাতে নিয়ে মল্লারের চোখ দিয়ে টপ টপ করে জল পরেছিলো।খুব ইচ্ছে করছিল একবার বাবাকে জড়িয়ে ধরে……….. কিন্তু অজ্ঞাত এক ভয় আর কুন্ঠা মল্লারের হাত পা আড়ষ্ট করে রেখেছিল।পারেনি বাবার কাছে এগিয়ে যেতে।
আমরা প্রত্যেকেই হয়তো মায়ের কাছে খুব সহজ, যেটা বাবার কাছে হতে পারিনা….তাই সাবলীল ভাবেই বলতে পারি “মাকে বেশি ভালোবাসি”। আর ঠিক একইভাবে মায়েরাও নিজের মমতায় জড়িয়ে থাকেন আমাদের।কিন্ত চোখের আড়ালে থেকে যায় বাবার ভালোরাসা,স্নেহ,ত্যাগ……আর অনেক অনেক না বলা অনুভূতি।
ভৈরবী দেবী মেয়ে আর নাতির সাথে আজ সারা দুপুরটা অনেক ভালো সময় কাটালেন।পুরনো স্মৃতি,ছেলেমানুষী, আড্ডা সব মিলিয়ে খুব আনন্দে কাটলো সময়।কিন্তু সময় সমুদ্রের স্রোতের মতো বোয়ে যায়…..ঘড়ি তে কখন যেন চারটে বেজে গেল এসবের মধ্যে অজান্তেই।
“টিং,টং”….
বেল বাজতেই মেঘ একলাফে খাট থেকে নেমে বলল,দাদু এসে গেছে। আমি যাচ্ছি দরজা খুলতে।দাদুকে বলবো আমার ঘড়ি টাও ইনসীয়োর করিয়ে দাও,কি বলো দিবু?
খুব সকাল সকাল একটু ভাতে ভাত ফুটিয়ে নিল নিলয়।কোনরকমে দুটো খেয়েই সাইকেল চালিয়ে পৌঁছে গেল নিমাইদার দোকানে।নিমাইদা তখন সবে ঠাকুরকে ধূপ দেখাচ্ছে। পূজো শেষ হতেই চোখের ইশারায় গোডাউনের পথ দেখিয়ে দিল নিলয়কে।নিলয়ও দায়িত্ব বুঝে নিয়ে ট্রলি ঠেলে কলেজের বাইরে জায়গা নিল।
আজ তার ট্রলিতে রকমারি রাখীর পসরা,দামী দামী চলোকেট,ছোটখাটো কিছু গিফ্ট আইটেম।নিমাইদার চালু দোকান।খদ্দেরের ভীড় সামলাতে পারে না নিমাইদা আর তার ছেলে সনৎ।তবু আরো একটু বেশি রোজগারের আশা ছাড়তে পারে না ওরা,পুরোদস্তুর ব্যবসায়ী আর কি!তাই নিলয়কে কলেজের সামনে দাঁড়িয়ে জিনিসপত্র বিক্রির ভার দিয়েছে। আজ রাখীবন্ধন। আনন্দের দিন।বিক্রির উপর কমিশন পাবে নিলয়।
সারাদিন দাঁড়িয়ে বিক্রি মন্দ হল না।কলেজের ছেলেমেয়েরা দলে দলে রাখী কিনল,এমনকি কেউ কেউ তো ওর ট্রলির সামনেই পোজ দিয়ে ছবিও তুললো। বিকেল হতেই নিলয় দোকানে এসে নিজের পাওনা গন্ডা বুঝে নিল, তারপর সাইকেল চালিয়ে আবার ছুট।এবার শাড়ির দোকান,পচ্ছন্দসই একটা ছাপা শাড়ি আর পাশের মিষ্টির দোকান থেকে এক হাঁড়ি রসগোল্লা কিনতেই আজকের টাকার প্রায় সবটাই চলে গেল।
আরো আধঘন্টা সাইকেল চালিয়ে যখন অমৃতার বাড়ি পৌঁছালো তখন প্রায় সাতটা বাজছে।
“তুই কি একটা বছরও এই দিনটা সকাল সকাল আসতে পারিস না?”
“কি করব বল।কারখানা থেকে ছুটি পাবো তবে না আসবো।কিন্তু অভয় এখনও ফেরেনি?তুই একা আছিস যে!”
একটা মেঘের ছায়া বয়ে যায় অমৃতার মুখের ওপর দিয়ে। খানিকটা দম নিয়ে যেন সে বলে,
“তার তো নেশা জমছে সবে।এখন কি ফিরবে?”
খানিকবাদে পেটভরে,মনভরে খাওয়াদাওয়া সারে নিলয়।শাড়িটা হাতে পেয়ে অমৃতার চোখের কোল ভিজে ওঠে।
“মনে আছে সেই আমবাগানে আম কুড়োনো?”
“সেই নদীতে সাঁতার?”
“আর সেই মার কাছে একে অপরের নামে মিথ্যে নালিশ? “
স্মৃতিচারণে ডুবে যায় দুটিতে।অমু আর নিলুর শৈশবযাপন।ঘোর ভাঙলে নিলয় ফেরার জন্য প্রস্তুতি নেয়।
“আবার কবে আসবি?”
“দেখি।”
ফেরার পথে নিলয়ের সাইকেল মন্থরগতিতে চলে,ভারবাহী পশুর মতো। নিলয় জানে বোনটা সুখী হয়নি।অথচ আজ আর অমৃতাকে বাড়ি চলে আসার কথা বলতে পারলো না।বাড়ি চলে এলে অমৃতা জেনে যাবে যে নিলয় অনেকদিন হল কারখানা থেকে ছাঁটাই হয়েছে। ছুটকোছাটকা কাজ করে কোনমতে পেট চলে।
অমৃতা দরজা বন্ধ করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। দাদাকে সে বলতে পারেনি যে অভয় আর তার সাথে থাকে না।অন্য একজনকে নিয়ে সে চলে গেছে।একদিন ভালবেসে অভয়কে বিয়ে করেছিল।আজ তাকে দাদার সামনে ছোট করতে মন সায় দিল না।
সেদিন অনেক রাত অব্দি ভাই বোন দুজনেই জেগেছিল,পূর্ণিমার চাঁদ তার স্নিগ্ধ আলোর চাদর মেলে দিচ্ছিল তাদের একাকী হৃদয়ের ওপর।ভ্রমের চাদরে ঢেকে দিচ্ছিল জীবনের দগদগে ঘা।
অরিন্দম আমি ডিভোর্স চাই। আমি তোমার কাছ থেকে কোনো ভরনপোষণ চাই না। বাচ্চা চাইলে তুমি তোমার কাছে রাখতে পারো।
অরিন্দম…অরুণিমা আর একটা বার ভেবে দেখলে হয়না। অন্তত আমাদের ছোট্ট তিতাশের কথা ভেবে। আমাদের মধ্যে তো কোনো দূরত্বও তৈরী হয়নি। আমাদের সুখের সংসারটা এভাবে ভেঙে দিওনা। সমস্ত কাজের ব্যস্ততার শেষে রাতে একটা শান্তি পেতাম জানোতো যখন তুমি আমার বুকে মাথা পেতে শুতে। আমাদের কতো কতো স্বপ্ন কতো স্মৃতি। সব কিছু তুমি এভাবে ভেঙে চলে যেতে পারছো। আমাদের বাচ্চাটার কথাটা একবার ভাবো ও মায়ের ভালোবাসা পাবেনা। ওর কথাটা একটা বার ভাবো।
অরুনিমা— আমি পারছিনা অরিন্দম সব কিছু তোমার সাথে মিলিয়ে নিতে। plzzz ডিভোর্স পেপারটা পাঠিয়ে দেবো সাইন কোরে দিও।
এভাবেই সেদিন সব কিছু ছেড়ে চলে গেছিলো অরুণিমা। আমাদের ভালোবাসা,আমাদের সন্তান তিতাশ সব কিছু ছেড়ে চলে গেছিলো। একটা বারের জন্যও ভাবেনি। পরিবর্তনটা ওর একদিনে আসেনি এসেছে দিনের পর দিন। ও যেন কিছুর নেশাতে মোহোগ্রস্থ হয়ে পরেছিলো। যেই মোহোর টানে সব কিছু ছেড়ে যেতে ও দুবারও ভাবেনি।
অরুনিমা এবার অন্তত ফোন ঘাটা বন্ধ করে তিতাশের কান্নাটা থামাও। ওর হয়তো খিদে পেয়েছে সেদিকে তো একটু নজর রাখো। সারা দিন ফেসবুক ফেসবুক। এবার অন্তত ফোন ঘাটা টা কমাও।
অরু…হ্যাঁ যাচ্ছি আর পাঁচ মিনিট। তুমি একটু তিতাশের কান্নাটা থামানোর চেষ্টা করো আমি আসছি।
যতদিন যাচ্ছে অরুণিমার মধ্যে সবকিছুতে যেন কেমন একটা অন্যমনষ্কতা দেখা দিয়েছে। আজকাল তো দেখছি ঠিকঠাক ভাবে আমাদের ছোট্ট ছেলে তিতাশের খেয়ালটুকু নেওয়াতেও কেমন যেন একটা বিরক্তি প্রবভনা।
এই কিছুদিন আগেও অরুনিমা নিজের ঘরে মন দিয়ে ফোন ঘেটে চলেছে ছোট্ট তিতাশ কখন যেন ঠাকুর ঘরে গিয়ে মোমবাতির আগুন ধরতে গেছে। অরিন্দম অফিস থেকে বাড়ি ফিরে ভাগ্যিস সঠিক সময়ে দেখতে পেয়েছিলো। নয়তো সেদিন একটা অনর্থক হয়েই যেতো।
এছাড়াও অরিন্দম যখনই অরুণিমাকে ফোন করতো সব সময় অন্য কলে ব্যস্ত দেখাতো। জিগ্যেস করলেই বলতো এই বান্ধবী ওই বান্ধবী। ফোন দেখতে চাইলে একটাই কথা তুমি আমায় সন্দেহ করছো।
অরিন্দম সেদিন মাঝরাতে ঘুম থেকে উঠে দেখে অরুণিমা পাশে শোয়া নেই। অরুণিমা বেলকনিতে কার সাথে যেন ফোনে ফিস ফিস করে কথা বলছে। দেখা মাত্রই ও অরুণিমার ফোনটা কেড়ে নেয়। অরিন্দম ফোন কানে দিতেই… ফোনের ওপাশ থেকে… আমাদের দেখাটা আবার কবে হবে। আগের দিন তোমাকে কতো সুন্দর লাগছিলো। তোমার মতো সুন্দরী বৌকে যে কিভাবে তোমার বর সুখ দিতে পারেনা কে জানে। আমি তোমাকে সব সুখে ভরিয়ে দেবো। ফোনের ওপার থেকে ছেলেটি বলে উঠলো… অরুণিমা কি হলো কথা বলছো না কেন। অরিন্দম ফোনটা ডিসকানেক্ট করে দেয়। বুঝতে বাকি রইলো না অরুণিমা পরকিয়ায় লিপ্ত। যাকে অগাত বিশ্বাস করেছে সেই কিনা এরকম করতে পারবে অরিন্দম স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি।
সেদিনে অরুনিমা ক্ষমা চেয়ে নেয় অরিন্দমের কাছ থেকে। অরুণিমা— এরকম আর দ্বিতীয় বার হবে না। আর একটা বার সুযোগ দেও। সব শুধরে নেবো আমি। আমি ভুল করেছি তুৃমি আমায় ক্ষমা করে দেও।
সেদিন বাচ্চার কথা ভেবে অরিন্দম ক্ষমা করে দিয়েছিলো। আর যাই হোক অরিন্দম পাগল এর মতো ভালোতো বাসতো। সেজন্যই হয়তো সেদিন অরুণিমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত বুলিয়ে বুঝিয়ে ছিলো এরকমটা আর করো না। আমি তোমাকে প্রচন্ড ভালোবাসি অরুণিমা। সেদিন অরুণিমাও কথা দিয়েছিলো এরকম ভুল আর দ্বিতীয় বার হবেনা।
তারপর বিগত একমাস অরুণিমা ঠিকঠাক থাকার অভিনয় করে নিজের পরকীয়া চালিয়ে যাচ্ছিলো। নিজের জায়গা গুছিয়ে অরিন্দমের কাছে আজ ডিভোর্স নিয়ে নেয়।
এদিকে ছোট্ট তিতাশকে তার ঠাম্মিই দেখাশোনা করে। কাজ শেষে রাতে সম্পূর্ণ সময়টুক অরিন্দম তার বাচ্চাকে দেওয়ার চেষ্টা করে। অরিন্দম আপ্রান চেষ্টা করে থাকে তিতাশকে মায়ের অভাব বুঝতে না দেওয়ার। তিতাশের এখন পাঁচবছর। ও কখনও মায়ের কথা জিগাসা করেনা। যে বাচ্চা মা শব্দটার সাথে পরিচিত নয় সে মার কথা জিগাসা করবেই বা কি করে। অরিন্দম তার বাচ্চার সুখের জন্য কখনও বিয়ে করার চিন্তাও করেনি। তিতাশকে ঘিরেই যেন অরিন্দমের পৃথিবী গড়ে উঠেছে।
অরিন্দম আর তিতাশ খেলা করছে এমম সময় দীর্ঘ পাচঁবছর পর হটাৎ অরুণিমার নম্বর থেকে ফোন বেজে উঠলো। যেই ফোনটার অপেক্ষা অরিন্দম দিনের পর দিন করে গেছে আজ হটাৎ এসব ভাবতে ভাবতেই ফোনটা কেটে যায়। দ্বিতীয় বার আবারো ফোন বেজে ওঠে। এবার ফোনটা অরিন্দম রিসিভ করেই ফেলে। অরুণিমা— হ্যালো অরিন্দম কেমন আছো আর আমাদের তিতাশ কেমন আছে। ভালো আছি তিতাশও ভালো আছে… নিশ্চই এই খোঁজ নেওয়ার জন্য তুমি আমায় ফোন করোনি এতোদিন পর। অরুণিমা— একটা কথা জিগাসা করবো। হ্যাঁ বলো…
তিতাশ আমার কথা জিগাসা করে??? না তিতাশ মা শব্দটার সাথে পরিচিত না। তিতাশ মায়ের ভালোবাসা,মায়ের অর্থ বোঝার আগেই তুমি ছেড়ে গেছো। আমিই ওর মা আমিই ওর বাবা।
অরুণিমা— তুমি বিয়ে করোনি অরিন্দম??? না আর কাউকে ভালোবাসতে পারার ক্ষমতা আমার নেই,আর কাউকে বিশ্বাস করার ক্ষমতা আমার নেই।
অরুণিমা— তুমি আমাকে এখনও ভালেবাসো অরিন্দম? না— সব ভালোবাসা তুমি শেষ করে দিয়ে গেছো সেদিন।
অরিন্দম — তুমি ভালো আছো তো? হ্যাঁ খুব ভালো আছি আমি।
অরিন্দম— যার জন্য আমাদের সুখের সংসার আমাকে,আমাদের বাচ্চাকে ছেড়ে যেতে তুমি ভাবোনি। তুমি তার সাথে ভালো থেকো আর কখনও আমাকে ফোন করোনা। অনেক কষ্টে আমি নিজেকে সামলেছি।
অরুণিমা— না আর কখনও ফোন করবো না। ভালো থেকো তোমারা তিতাশের খেয়াল নিও। পারলে আমায় ক্ষমা করে দিও। এই বলেই ফোন ডিসকানেক্ট হয়েছিলো। অরিন্দম নিজের আবেগকে কন্ট্রোল করে আবারো তিতাশের সাথে খেলায় মেতে উঠলো।
পরের দিন সকালে অরিন্দম খবরের কাগজ পড়তে পড়তে চোখ পড়লো দ্বিতীয় পেজে। বড়ো বড়ো করে লেখা আর এক গৃহবধূর সুইসাইড। স্বামী পরকীয়ায় লিপ্ত, স্বামী ছেড়ে যাওয়ার কষ্ট সহ্য করতে না পেরে অরুণিমা রায় মৃত্যুর পথ বেছে নেয় কাল রাতে।
অরিন্দম যেন কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিলো না। খানিক্ষন পর নিজের মনকে শান্ত করে…
নিজ মনেই বলে উঠলো অরুণিমা তুমি তো সুখে থাকতে চেয়েছিলে আমাকে ছেড়ে তবে আজ কেন এমন পথ বেঁছে নিলে। তুমি তো সুখে থাকতে চেয়েছিলে তবে আজ কেন সুখে থাকতে পারলে না।